পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) একটি নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় ‘ইউনিফর্ম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করা হবে, যার মাধ্যমে ব্রোকারেজ হাউসগুলো তাদের সমন্বিত গ্রাহক হিসাব (সিসিএ) সম্পর্কিত তথ্য প্রতিদিন স্টক এক্সচেঞ্জে সরবরাহ করবে।
এই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করার জন্য ইতিমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং তারা কাজ শুরু করেছে। নতুন সিস্টেমে ব্রোকারেজ হাউসগুলো তাদের সিসিএ হিসাবের তথ্য একত্র করে স্টক এক্সচেঞ্জে প্রদান করবে, যেখান থেকে এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে যেকোনো অসংগতি বা শৈথিল্য ধরা পড়লে তা সংশোধন করা হবে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের অর্থ বা শেয়ার লোপাটের আশঙ্কা কমে যাবে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানিয়েছেন, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ব্রোকারেজ হাউসগুলো থেকে অর্থ বা সিকিউরিটিজ তছরুপের ঘটনা কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, এটি পুঁজিবাজারে সুপারভিশন এবং মনিটরিং বাড়াবে, যার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
তবে, পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ‘দেশের বর্তমান পুঁজিবাজারের প্রেক্ষাপটে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি এবং প্ল্যাটফর্ম পরিচালনায় পর্যাপ্ত লোকবল এবং সময়ের প্রয়োজন।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি সব পক্ষের সহযোগিতা না পাওয়া যায়, তাহলে এই পরিকল্পনা সফল হতে পারবে না।
সাইফুল ইসলাম আরও যোগ করেন, ‘এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হলে বিএসইসির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্ল্যাটফর্মের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সিসিএ থেকে অর্থ ও শেয়ার লোপাটের আশঙ্কা কমে আসে।’ বিএসইসির নতুন উদ্যোগটি প্রশংসিত হলেও এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যাপক প্রস্তুতি এবং সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, যদি সঠিকভাবে এবং সমন্বিতভাবে কাজ করা যায়, তবে বিনিয়োগকারীদের পুঁজি সুরক্ষিত রাখতে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত ৩১ অক্টোবর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) একটি চিঠি পাঠিয়েছে, যাতে ইউনিফর্ম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির অগ্রগতি জানাতে বলা হয়েছে। চিঠি সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল ডিএসই ও সিএসইর সঙ্গে ইউনিফর্ম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করার বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের পর বিএসইসি ৯ অক্টোবর ডিএসই ও সিএসইকে প্ল্যাটফর্ম তৈরির নির্দেশনা দেয়। পরে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, বিএসইসি অতিরিক্ত ২০ কার্যদিবস সময় (৬ নভেম্বর পর্যন্ত) দিয়েছে। বিএসইসি এখন স্টক এক্সচেঞ্জগুলোকে ইউনিফর্ম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাতে বলেছে।
যা করার নির্দেশ
দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে ইউনিফর্ম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির নির্দেশনায় বলা হয়, স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর জন্য সিসিএ (সমন্বিত গ্রাহক হিসাব) গণনার বর্তমান পদ্ধতি যাচাই এবং একটি মানসম্মত ফরম্যাট তৈরি করতে হবে। এই ফরম্যাটটি কমিশনে জমা দিতে হবে এবং এক্সচেঞ্জগুলোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। নতুন প্ল্যাটফর্মে, স্টক ব্রোকাররা প্রতিদিনের লেনদেন শেষে তাঁদের সিসিএ তথ্য আপডেট করবেন। ডিএসই ও সিএসই নিয়মিতভাবে এই তথ্য পর্যালোচনা করবে এবং যেকোনো অসংগতি পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
অগ্রগতি কোন পর্যায়ে
এদিকে ডিএসই ও সিএসই সূত্রে জানা গেছে, ইউনিফর্ম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ডিএসই একটি কমিটি গঠন করেছে এবং শিগগিরই বিএসইসিতে একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ জি এম সাত্বিক আহমেদ শাহ জানান, প্ল্যাটফর্ম তৈরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, সিডিবিএল, সিসিবিএল এবং ব্রোকার হাউসের সমন্বয়ে একটি টিম কাজ করছে। যাদের গবেষণা এখনো চলছে। শিগগিরই প্রতিবেদন বিএসইসিতে জমা দেওয়া হবে।
বাস্তবায়ন নিয়ে চ্যালেঞ্জ
বিদ্যমান বাস্তবতায় সমন্বিত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির বিষয়টি খুবই চ্যালেঞ্জের। ডিএসইর এক সদস্য জানালেন, প্রায় ৯০০ ব্রোকারেজ হাউসের ব্যাক অফিস সফটওয়্যারের তথ্য মিলিয়ে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সেটেলমেন্ট তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করা প্রায় অসম্ভব। ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন ও সিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম সাইফুর রহমান মজুমদার এ উদ্যোগকে কঠিন ও সময়সাপেক্ষ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, বাজারে প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নেই। এদিকে, ট্রেজার সিকিউরিটিজের কর্মকর্তা মোস্তফা মাহবুব উল্লাহ প্রস্তাব করেন, ব্রোকারেজ হাউসের সফটওয়্যারকে বিনিয়োগকারীর ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে সংযুক্ত করে সরাসরি সেটেলমেন্ট করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এতে স্টক এক্সচেঞ্জের ওপর চাপ কমবে।